ভূমিকম্পে মৃত্যুপুরী ইতালি : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৪৭

মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ইতালির মধ্যাঞ্চল। রাজধানী রোম থেকে আমাট্রিস শহর পর্যন্ত চারদিকে ধ্বংসস্ত‚প। স্ত‚পের ভেতর শুধু লাশ আর লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ। স্বজন হারানোর কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে পুরো পরিবেশ। ধ্বংসস্ত‚পে আটকেপড়া স্বজনদের উদ্ধারের আকুতি চারদিকে। স্বজন হারানো মানুষের মাতম আর আহতদের আর্তনাদে সেখানকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। কান্না গ্রাস করেছে পুরো ইতালিকে। গত মঙ্গলবারের ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প বিরানভূমি করে দিয়েছে ইতালির মধ্যাঞ্চল। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪৭ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। ধ্বংসস্ত‚পের ভেতরে রয়েছে আরো লাশ। এখনো অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ। আহত অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফলে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতের শেষভাগে ইতালির মধ্যাঞ্চলে আঘাত হানে ৬ দশমিক ২ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পুরো ইতালি। ধসে যায় বিশালকায় অট্টালিকা, মানুষের সাধারণ আবাসস্থল। শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। ভূমিকম্পে আমাট্রিস শহরের হোটেল রোমা ধসে পড়েছে। এতে ছিলেন ৭০ জন অতিথি। সেখান থেকে মাত্র ৭টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিদের এখনো কোনো হদিস মেলেনি। তাৎক্ষণিকভাবে ৩৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রতি মুহূর্তে বাড়তে থাকে লাশের সংখ্যা। বাড়তে থাকে বেঁচে থাকার আকুতি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়ে যায়। রোমের নাগরিক সুরক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, স্থানীয় কর্মকর্তাদের দেয়া হিসাবে দেখা গেছে, রেইতি প্রদেশে নিহত হয়েছে ১৯০ জন এবং আসকোলি পিসেনো প্রদেশে নিহত হয়েছে ৫৭ জন। দুর্যোগ মোকাবেলায় গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদের জরুরি সভা করেন প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি।

ইতালির ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ল্যাজিও ও মারচে অঞ্চলে। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ল্যাজিওতে। ভূমিকম্পে পার্শ্ববর্তী আমব্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ তিনটি অঞ্চলেই দীর্ঘদিন ধরে কয়েক শতাব্দীর পুরনো ভবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে এগুলো ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ। ঐতিহাসিক আমাত্রিচ শহরের মেয়র স্টেফানো পেত্রুচ্চিস বলেছেন, ভূমিকম্পে শহরটির তিন-চতুর্থাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে।

গত বুধবার রাতে উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্ত‚পের ভেতর থেকে উদ্ধার করে আনেন ৮ মাস ও ৯ বছর বয়সী দুটি শিশুর লাশ। পিতামাতার সঙ্গে তারাও ভবন চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। তাদের লাশ দেখে সেখানে উপস্থিত সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাড়তে থাকে বেঁচে থাকার আকুতি। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, গত রাতভর উদ্ধারকর্মীরা জীবিতদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন।

গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি সাংবাদিকদের বলেন, এ দিনটি হলো কান্নার। আগামী দিনগুলো হলো পুনর্গঠনের। আমাট্রিস শহরের মেয়র বলেছেন, এবারের ভূমিকম্পে এ শহরটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে লোকালয়। রাস্তাগুলোতে মারাত্মক সব ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। এটি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ভূমিধসের সমূহ আশঙ্কা করা হচ্ছে। যারা বেঁচে আছেন তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

হাজার হাজার মানুষ অবস্থান করছেন তাঁবুতে। তাতে আশ্রয় নেয়া আলেসান্দ্রো গাব্রিয়েলি বলেছেন, রাতগুলো হবে আমাদের কাছে সবচেয়ে ভীতিকর। প্রতিটি তাঁবুতে অবস্থান করছেন ১২ জন করে মানুষ। এমন তাঁবু পাতা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে, পার্কিং এলাকায়। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে আমাদের ঘুম ভেঙেছে বিকট শব্দে। মনে হচ্ছিল বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে কোথাও।

ওদিকে উদ্ধারকর্মীরা অন্ধকারের ভেতরেই ধ্বংসস্ত‚পের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার করেছেন ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে শিশুকে। পেসকারা ডেল ট্রোনটোতে একটি ধ্বংসস্ত‚পের নিচে আটকা পড়েছিল শিশুটি প্রায় ১৭ ঘণ্টা। কিন্তু তার মতো সৌভাগ্যবান নয় অন্য অনেক শিশু। আকুমোলি শহরের পাশে একটি গ্রামে চার সদস্যের একটি পরিবার চাপা পড়েছে ধ্বংসস্ত‚পের নিচে।

গতকাল বিবিসির এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ধ্বংসস্ত‚পের নিচে অনেকেই আটকা পড়েছে। তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী। পার্বত্য এলাকার গ্রাম ও শহরগুলোতে এ ভূমিকম্প হওয়ায় উদ্ধার কাজ খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। উদ্ধার কাজে নিয়োজিত আছেন চার হাজার তিনশর বেশি কর্মী। ভূমিকম্পে দেশটির মধ্যাঞ্চলের পার্বত্য এলাকাগুলোর শহর ও গ্রামগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর তেমন ক্ষতি হয়নি বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতালির সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, উদ্ধারকার্যে প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এজন্য প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ইতালির রেড ক্রসের মুখপাত্র টমাসো ডেলা লংগা বিবিসিকে বলেন, যে মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা ভয়াবহ। শহরের কিছু অংশ মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। এই অবস্থার মধ্যে আমরা রাতের খাবার তৈরি করার জন্য কিছু রান্নার ব্যবস্থা করছি। সেটি যদি সম্ভব না হয় তাহলে শুক্রবার আমরা খাবার তৈরি করব। দিনভর সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল ট্রাক এবং অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলোতে নিয়ে যাওয়া।

সম্প্রতি ইটালিতে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ২০০৯ সালে, যাতে তিন শতাধিক মানুষ মারা যায়। এছাড়াও ২০১২ সালে নয় দিনের ব্যবধানে দুটি ভূমিকম্পে ২০ জনের বেশি নিহত হয়।

শুক্রবার, ২৬ আগস্ট ২০১৬
Poramorsho TV
Poramorsho TV

Previous
Next Post »
Photo-1 Photo-2 Photo-3 Photo-4 Photo-5